বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ১ মুদ্রার এপিট-ওপিট

বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাঃ

তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ” বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য়” ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি অন্ধকার রুমে বন্দী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্টিমরোলার চলছে। জল্লাদ প্রস্তুত। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতাকে শূলে চড়ানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন পাকিস্তানি শোসক গোষ্ঠীর! বঙ্গবন্ধু’র হাতে দুটি পথ খোলা। মৃত্যু অথবা সমঝোতা’র মাধ্যমে স্বাধীন ভূখন্ডের স্বপ্নকে বিসর্জন দেওয়া। বঙ্গবন্ধু জীবনের বিনিময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি কে বেছে নিলেন।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ১ মুদ্রার এপিট-ওপিট
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ মুদ্রার এপিট-ওপিট
ক্যান্টনমেন্টে বন্দীঃ

ক্যান্টনমেন্টে বন্দী রুম থেকে বের হন না জাতির পিতা। আর রাজপথে আন্দোলনের তীব্র দাবানল। লাঠিচার্জে ছত্রভঙ্গ করা যাচ্ছে না বিপ্লবী বাঙালি জাতি কে। বাধ্য হয়ে মিছিল সমাবেশে নির্বিচারে গুলি করছে পাক হানাদার বাহিনী। লাশের পর লাশ পড়ে যাচ্ছে। শূন্যস্থানে নতুন প্রাণ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ছয় দফা আন্দোলন ততোদিনে একদফা’র গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। বাংলা ভূখন্ডের আপামর জনতার প্রাণের স্লোগান “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করো” এ রাজপথ উত্তাল।

মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু উপাধিঃ

দিশেহারা স্বৈরাচারী গোষ্ঠী একসময় পালানোর পথ খুঁজতে লাগল। আন্দোলনের গণজোয়ারে ভেসে গেলো “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামের ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিঃশর্তে মুক্ত হয়ে এলেন। মুক্তির একদিন পর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে লাখো জনতার সামনে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত হন। দিনটি ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ সন।

প্রাপ্ত উপাধি’র সার্থকতা বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করে গেছেন কর্মের মধ্য দিয়ে। আমৃত্যু বলে গেছেন জনপদের দুঃখী মেহনতি মানুষের কথা। মানুষকে একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ উপহার দিতে গিয়ে নিজের জীবনটাও বিসর্জন দিয়ে গেছেন।

কিছু জিনিস কে কখনো আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই; তাহলে আপনি অস্তিত্ব সংকটে পড়বেন। যেমন সন্তানের জীবন থেকে মাতৃ পরিচয় কখনো আলাদা করা যায় না। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু ঠিক এমনই এক নাম। যারা ভাবেন বঙ্গবন্ধু একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর তারা মূলত সত্যকে স্বীকার করতে চায় না অথবা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।

একটা মানুষকে ভালোবাসতে হলে তার সম্পর্কে জানতে হয়। দূর্ভাগ্যবশত আমরা বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে যতটা জেনেছি; তারচেয়ে বেশী বিশ্বাস করেছি তাকে নিয়ে নানান উদ্ভট গুজবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (স.) এর চরিত্র হনন করতে যেখানে দ্বিধাবোধ করে নাই; সেখানে বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে মুখরোচক কল্পকাহিনির অবতারণা স্বাভাবিকই বটে।

শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালঃ

এখনও বাংলাদেশের অনেক মানুষ বাকশাল’কে অভিশাপ মনে করে। আবার আমলাতন্ত্র কে গালি দেয়। এরা জানে না বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে কি দারুণভাবে বাংলা ভূখন্ড বের হয়ে আসতো ব্যুরোক্র্যাসির জাঁতাকল থেকে। স্বৈরশাসক বলে বঙ্গবন্ধু কে হত্যা করা হয়েছিল। দুটি প্রশ্ন কেউ কখনো করে না: এক. বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে যে মানুষটি ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেও প্রস্তুত ছিলেন তিনি স্বৈরশাসক হন কি করে? সেসময়ে বঙ্গবন্ধুর বিকল্প কোন নেতা কি বাংলাদেশে ছিলেন? তাহলে তাঁর জোর করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা কি? দুই. যারা গণতন্ত্র  প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু কে হত্যা করেছিল তারা কি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল? ক্যান্টনমেন্টের ইশারায় দেশ চালানোই কি তাহলে গণতন্ত্র?  যে গণতন্ত্রের কথা বলে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু কে হত্যা করা হলো নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ই আবার আন্দোলন করে সেই গণতন্ত্র কে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুনরুদ্ধার করে ক্ষমতার উৎস জনগণের হাতে তুলে দিয়েছিলো। ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্র মূলত চুরি হয়েছিলো মিলিটারী শাসনের কাছে। ভূলন্ঠিত হয়েছিলো নির্বাচন ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেই গণতন্ত্র ফিরেছে নব্বই এর দশকে।

পরিবারঃ

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তারচেয়ে বেশী মানি মিথ্যে গল্পগুলো। আমরা বিশ্বাস করি শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাত ছিলেন! শেখ কামাল উঠিয়ে এনেছিলেন ডালিমের স্ত্রী কে! অথচ ডালিম নিজেই তার বই এ এই গল্পকে মিথ্যা দাবি করে গেলেও কামালের কপাল থেকে অপবাদ  মুছে নাই। কতজন জানে শেখ কামাল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কতজন জানে শেখ কামাল দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী’র এডিসি হিসেবে। গল্পের আড়ালে প্রশ্নগুলো বরারবরই রয়ে যায় অপ্রকাশিত। শেখ কামাল যদি ব্যাংক ডাকাত ই হতেন তাহলে তার মৃত্যুর পর একটি টাকাও কেন উদ্ধার করা গেলো না? একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলের ব্যাংক ডাকাতি করে টাকা কামাতে হবে এটা হয়তো বাঙালি জাতি ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না! আমরা কেন ভাবি না একজন প্রধানমন্ত্রী’র বাড়িতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা’র ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিলো না। এই সাদামাটা জীবন ধারণ যদি জাস্টিন ট্রুডু করতো তাহলে বিষ্ময়ের অন্ত থাকতো না। বাংলা ভাষায় গল্প কবিতার হিরিক পড়ে যেতো। বাঙালি নারীরা তার প্রেমে পড়তো অনায়াসে। মানুষটা বঙ্গবন্ধু তাই কেউ বিস্মিত হয় না। কথায় আছে ঘরের গরু দুয়ারের ঘাস খায় না। আমাদের অবস্থাও এমনই।

বহু মানুষের প্রশ্ন- শেখ মুজিবুর রহমান কি একা দেশ স্বাধীন করেছে?? ইংরেজি’তে একটা কথা আছে- “হু উইল বেল দ্যা কেট” অর্থাৎ বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন শোষণের শৃঙ্খলে  পিষ্ট হচ্ছিলো তখন একজন মানুষ শোষকদের বিরুদ্ধে তর্জনী উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করেছে একটি সম্প্রদায়। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধে জিতে আসার আগে প্রয়োজন, যুদ্ধ শুরু করা। সেই সাহসিকতা বুকে লালন করতেন বঙ্গবন্ধু।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দুটি পক্ষ এখনও রয়ে গেছে। একটি স্বাধীনতা’র পক্ষে আর অপরটি পেয়ারে পাকিস্তান সমর্থক গোষ্ঠী। পেয়ার পাকিস্তান সমর্থক গোষ্ঠী’র অন্তরের ভিতরে এখনও জিন্দাবাদ স্লোগান। ‘জয় বাংলা’ শুনলে তাদের শরীরের মাংস খসে পড়ে। এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী কখনো নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কে মেনে নিতে পারে নাই। তাদের উত্তরসূরীরাও পারবে না। এরাই পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা শেখ মুজিব কে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চেয়েছিল। জাতির পিতাকে কে নিয়ে যত মিথ্যা গল্প সবই এদের ড্রয়িং রুমে রচিত। কিন্তু তারা জানে না রক্ত দিয়ে লেখা ইতিহাস মুছা যায় না। যতবার সত্য ইতিহাসকে তারা মাটিচাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে ততবারই তা কালো মেঘ ভেদ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে তারা বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে হত্যা করে ভেবেছিলো বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু’র কথা বলার মতো কেউ অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আজকে সেই বঙ্গবন্ধু’র দল আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতায়।

বাঙ্গালী জাতির মহান নেতা ও জাতির জনকঃ

টুঙ্গিপাড়া’র সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা-মাতা’র আদরের খোকা থেকে পরিণত হয়েছিলেন বাংলাদেশের একক নেতা’য়।
মানুষকে ভালোবেসেই যে শত সহস্র বছর বেঁচে থাকা যায় তার উজ্জল দৃষ্টান্ত। একটি দেশের প্রধান। অথচ নিজেকে কখনো শাসক মনে করেন নাই। কি সাধারণ তার জীবন যাপন। বাংলাদেশের কৃষক, ড্রাইভার, দিনমজুরের প্রবেশাধিকার ছিলো তার বাড়িতে। সাদা সেন্ডো গেঞ্জি পড়ে তিনি জনগণের সাথে কথা বলতেন। সরাসরি তাদের অভিযোগ শুনতেন। আধুনিক বিশ্বের কতজন শাসকের মাঝে এমন উদার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়? নেই বললেই চলে।

শেষ করবো। তার পূ্র্বে বলি শেখ মুজিবুর রহমান; লিখে গেছেন রাজনীতি’র অমর কবিতা। প্রজন্মের যারা রাজনীতি করতে চায় তাদের জানতে হবে সেই ইতিহাস। জানতে হবে কি করে আদর্শকে বুকে ধারণ করে লক্ষ্যপাণে অবিচল থাকতে হয়। তবে’ই প্রতিষ্ঠিত হবে স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা।

-লেখক

ফায়েজ মোনতাছির চৌধুরী মাহিয়ান
চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সংগঠক

বে অব বেঙ্গল নিউজ / bay of bengal news / BBN / বি বি এন / সম্পাদকীয়

Comments are closed.