সকল সংবাদবিনোদন

আরেকটা পুরষ্কার এর অপেক্ষায় তারিক আনাম খান

শনিবার বিকেলের শুটিংয়ে ১০ মিনিট বিরতি পেয়েছিলেন অভিনেতা তারিক আনাম খান, আমাদের নায়ক। কেন্দ্রীয় চরিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন তিনি। শুটিং বিরতিতে ফোন ধরে বললেন, ‘হ্যালো।’

‘নায়ক হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। কেমন লাগছে?’ ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শোনা যায় পরিচিত হাসিমাখা স্বর। তারিক আনাম খান বলেন, ‘নায়ক সম্বোধন শুনে ভালো লাগছে। কিন্তু এটাকে নায়ক হিসেবে পাওয়া পুরস্কার মনে করি না।’ তাঁর কথার পিঠে বলি, ‘এনএসডিতে তো নায়ক হতেই গিয়েছিলেন? তারপরের কথা মনে পড়ে?’ তারিক আনাম খান আলতো করে তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরেন।

‘ছোটবেলায় নায়ক–নায়িকা দেখেই সিনেমা চিনতে শুরু করি। এনএসডিতে নাসিরুদ্দিন শাহ, ওমপুরিদের দেখে নায়ক–নায়িকার ধারণা ভেঙে গেছে। তখন শ্যাম বেনেগালরা সিনেমা বানাতে শুরু করলেন, শাবানা আজমিরা করছিলেন অভিনয়। সিনেমায় তখন আসে একটা নতুন ঘরানা! আমাদের চোখের সামনে তখন নায়ক–নায়িকা কনসেপ্ট বদলে যায়। আমি যখন অভিনয় করি, তখন মাথায় থাকে চরিত্র। তখন চরিত্রের সুখ–দুঃখ, উত্থান–পতন নিজের বলে মনে হয়।’

‘আবার বসন্ত’ সিনেমায় অভিনয় করে আবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন তারিক আনাম খান। ছবিটির তরুণ পরিচালক অনন্য মামুনের সঙ্গে আগেও কাজ করেছেন তিনি।

বড় অভিনেতা যেমন নিজেকে তুলে দেন পরিচালকের হাতে, তিনিও দেন এখনো।এমনকি এখনকার তরুণদের ওপর যথেষ্ট আস্থাও রাখেন তিনি। একজন জ্যেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তাঁকে নতুন চ্যালেঞ্জ দেন তরুণেরা, নিজেরাও চ্যালেঞ্জ নেন—এটা তাঁকে আশাবাদী করে।

এই পুরস্কারে কী যায় আসে তাঁর? তারিক বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভীষণ সক্রিয় এখন। মানুষ সেখানে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এমন কিছু মানুষের ফোন পাচ্ছি, যারা ফোন করার কথা নয়। পরিচিত এক ডক্টর ফেসবুকে লিখেছেন, ফোন করেছেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেছেন, এসব তো ছিল না আগে। একটা নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। যাঁরা আমাকে পছন্দ করেন, তাঁরা অনুপ্রাণিত করছেন। যাঁরা করেন না, তাঁরা হয়তো ভাবছেন “কী হলো এটা!” সমাজে অবশ্য এ দুটো ব্যাপারই সত্য। তবে পুরস্কার না পেলে মুষড়ে পড়তাম না। আগেও বেশ কিছু ছবিতে কাজ করার জন্য জাতীয় পুরস্কার আশা করেছিলাম। পাইনি বলে অভিযোগ নেই আমার।’

ফোনের ওপাশ থেকে শুটিং পরিবেশের শব্দ শোনা যায়। হয়তো অভিনেতার ডাক আসবে এক্ষুনি। সেসব মাথায় রেখে জানতে চাই, ছেলে আরিক ও ছেলের বউ প্রিয়াঙ্কার প্রতিক্রিয়া কী? বাবা তো তাঁদের আসল নায়ক! তারিক বলেন, ‘ওরা ভীষণ খুশি।

এখনকার সময়ে তাদের কাছে এটা খুব ম্যাটার করে। বহু আগের একটা মেডেলের কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৭২–৭৩ সালের দিকে সাতক্ষীরায় একটা নাটক করেছিলাম, খুব দাপুটে একটা চরিত্রে। এক মুগ্ধ দর্শক এসে বললেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে একটা মেডেল দেবেন। কিন্তু সেটা আবার তাঁকে ফেরত দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, নিলে আর ফেরত দেব না। অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর তিনি বলেছিলেন, “ঠিক আছে মেডেলটা আপনিই নিয়েন।”’

মানুষের বুকের ভেতর যে ছবি আছে, সেটাকে শিল্পে তুলে ধরতে হবে। হোক সেটা মঞ্চ বা পর্দায়। মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শিল্পকে মেলাতে হবে। এ জন্য সবাইকে নতুন আন্তরিকতায় কাজে নামতে হবে।

আরেকটা পুরষ্কার এর অপেক্ষায় তারিক আনাম খান
আরেকটা পুরষ্কার এর অপেক্ষায় তারিক আনাম খান

২০১৪ সালে খলনায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তারিক আনাম খান। অভিনয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ার। এখনো অভিনয়কে ভীষণ উপভোগ করেন, এখনো রোমাঞ্চিত হন, অনুপ্রাণিত হন। বিশ্বাস করেন, এই অনুপ্রেরণাই শিল্পের উৎস। কিন্তু তাঁকে কি যথেষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে? ‘আশপাশের অনেকে বলে, আমি আন্ডার ইউজড। কিন্তু আমার সৌভাগ্য তরুণ অনেক নির্মাতা আমার সঙ্গে কাজের আগ্রহ দেখায়। অনেক পরিচালক আমাকে ব্যতিক্রম চরিত্রে ভাবছে, সেটা আমাকে অনুপ্রাণিত করে’, একটু ভেবে বলেন তিনি।

তাঁদের সময়ে একমাত্র চ্যানেল ছিল বিটিভি। সেখানে কাজের সুযোগ মিলত বহু কষ্টে। একবার অডিও তারপর ভিডিও অডিশন, তারপর হতো বাছাই। একটা সাপ্তাহিক নাটক হতো, যার গল্প খুব বেছে নেওয়া হতো। এসবের মধ্যে বেড়ে ওঠায় কিছু সুবিধা তাঁরা পেতেন। তারিক বলেন, ‘তখন হুমায়ুন ফরীদি একটা ভালো কাজ করলে মনে হতো, ফরীদি পারলে আমরা কেন পারব না। আফজাল বা আসাদ বা নূর ভাই করলে আমরাও সাহস পেতাম। এই চ্যালেঞ্জ এখন কমে গেছে। হয়তো মিডিয়া বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমে গেছে।’

মঞ্চ, টেলিভিশন ও সিনেমার গৌরব ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোকে ফেরাতে কী করা উচিত? জানতে চাইলে তারিক আনাম খান বলেন, ‘মানুষের বুকের ভেতর যে ছবি আছে, সেটাকে শিল্পে তুলে ধরতে হবে। হোক সেটা মঞ্চ বা পর্দায়। মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শিল্পকে মেলাতে হবে। এ জন্য সবাইকে নতুন আন্তরিকতায় কাজে নামতে হবে। ৪০ বছর আগের মতো করে গ্রুপ থিয়েটার করলে হবে না।

নতুন পৃথিবীর সঙ্গে মিলিয়ে, নতুন আলোয় সবকিছু দেখতে হবে। আমাদের আশপাশের দেশগুলো সেভাবেই করছে।’কথা শেষ করার আগে জানতে চাই, এখনো করা হয়নি এমন কী করতে চান?

তিনি বলেন, ‘আমাকে এখন খুব টানে ক্ল্যাসিক। শেক্‌সপিয়রের অনূদিত কোনো কাজ বা ঐতিহাসিক গল্প বা বিগ ট্র্যাজেডি। বর্তমান সময়ের সঙ্গে কীভাবে সেগুলোকে মেলানো যায়, সেটাই ভাবি সব সময়। ধরা যাক, যদি “ইডিপাস” করি, তাহলে সেটাকে আজকের জন্য কীভাবে প্রাসঙ্গিত করা যায়, সেটা ভাবি।’

তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে আলী যাকেরকে মনে পড়ে যায়। আলী যাকের নামটা উচ্চারণ করতেই উৎসুক কণ্ঠে তারিক আনাম খান বলেন, ‘নবনাট্যধারার সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। “বিজয়” নামে তাঁর করা একটি চরিত্র ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল আমাকে। বিভিন্ন সময় তাঁর কাছে গিয়েছি। এনএসডিতে যাওয়ার আগেও। যে নতুন ধারা তাঁরা তৈরি করেছিলেন, সেটা ধরেই আমরা শুরু করেছিলাম। তাঁর প্রতি সেই কৃতজ্ঞতা আমার আছে। সে জন্যই আমার পুরস্কারটা তাঁকে উৎসর্গ করতে চাই।’

সেট থেকে ডাক আসে। তিনি ফিরে যান ক্যামেরার সামনে, অভিনেতার নির্ধারিত এবং একমাত্র কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

মো ইমাম হোসেন আসিফ
স্টাফ রিপোর্টার/বে অব বেঙ্গল নিউজ/Bay of bengal news/বিবিএন

বে অব বেঙ্গল নিউজ - Bay of Bengal News

বে অব বেঙ্গল নিউজ