মধ্যবিত্তের ক্ষতি হলে দেশ মাফিয়াদের দখলে যাবে | অ্যাডভোকেট শফিউল আজম
করোনা মহামারীর কারণে কমবেশী সকল শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তবে মধ্যবিত্তের ক্ষতিটাই সর্বাধিক। যেকোন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে তার নাগরিকের মধ্যবিত্ত অংশের উপর। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিস্তার এবং উন্নতির উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের অর্থনীতির গতি। ১৯৭৮ সালের আগেও চীনের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করত অথচ মাত্র চল্লিশ বছরের ব্যবধানে চীন সে অবস্থার ব্যাপক উন্নতি করেছে আর তা সম্ভব হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্নয়নের মাধ্যমেই।
একটি আন্তর্জাতিক জরিপ মতে- বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক মধ্যবিত্তের বসবাস চীনসহ পুর্ব এশিয়ায় এবং ভারতসহ দক্ষিন এশিয়া দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ। যাই হোক মুল কথা হল, ৯০ দশক থেকে বিশ্বব্যাপী ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা করোনা মারীর কারণে এই প্রথম আশংকাজনক হারে কমে গেছে। আয় কমে তারা দরিদ্র তালিকায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মধ্যবিত্তের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে কোভিড মহামারি। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, কোভিড-১৯–এর কারণে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমেছে ৯ কোটি। আয় কমে যাওয়ায় বিশ্বের মধ্যবিত্তের বড় অংশই দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। কোভিডের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে ৭ কোটি ৮০ লাখ।
মূলত,এরা প্রায় সবাই মধ্যবিত্তের ঘরে নাম লিখিয়েছিল, আয় কমায় তারাই নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। যেমন মহামারির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যবিত্ত কমবে ৩ কোটি ২০ লাখ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মহামারির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। আমরা শংকিত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নিয়ে। চীন মহামারী কাটিয়ে উঠার কারণে পুর্ব এশিয়ায় মধ্যবিত্তের সংখ্যায় তেমন হেরফের হচ্ছেনা।
আমরা প্রায় সবাই জানি,স্বাধীনতা পরবর্তী তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৮২% এরও অধিক মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করত। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি,আমরা ছিলাম সর্বোতভাবে বিদেশী সাহায্যনির্ভর দরিদ্র দেশ।
১৯৯৬ সালের পর থেকে আমাদের অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে ঘুরতে শুরু করে।আমাদের বিশাল জনগোষ্টিকে জনশক্তিতে পরিণত করা,গণমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রনয়ন, কৃষিতে ব্যাপক হারে ভর্তুকী প্রদান,রপ্তানীমুখী শিল্প ও জনশক্তি রপ্তানীসহ বিভিন্ন যুগান্তকারী অর্থনৈতিক কর্মসুচী বাস্তবায়নের ফলে আমাদের খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী মজবুত হতে শুরু করে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিস্তার ঘঠতে থাকে।
১৯৯২ সালে দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৯শতাংশের কাছাকাছি। মাত্র গত তিন দশকের কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ তার মধ্যবিক্তের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে করোনাপূর্ব সময়ে আমরা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্টির সংখ্যা ২০% এর নীচে নামিয়ে এনে দেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে উপনীত করে দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে অবস্থান করাতে সক্ষম হয়েছি।২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেককে মধ্যবিত্তে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
মধ্যবিত্তের এ অগ্রগতিই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,বাংলাদেশে ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিরাই ছিলেন মধ্যমণি। তাঁরা ভালো পেশাজীবী ছিলেন, গণসম্পৃক্ত রাজনীতিক ছিলেন, এরাই সমাজ সরকার রাষ্ট্রের প্রতিনিধির যোগান দিতেন। দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলও মধ্যবিত্তেরই নেতৃত্বে ছিল। তাঁরা যাকে ভালো বলতেন, জনগণের কাছে তারা ভালো বলে গণ্য হতো।
কিন্তু ৯০ দশকের পর থেকে রাজনীতিতে ধনিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর অনুপ্রবেশ ঘঠতে থাকে এবং মধ্যবিত্তের উঠতি মেধাবী অংশ দেশ ছেড়ে বিদেশী সুযোগ সুবিধার দিকে অাসক্ত হয়ে দেশান্তরী হতে শুরু করে।যাই হোক্ গতবছর থেকে কোভিডের যাঁতাকলে পড়ে মধ্যবিত্তের বিরাট অংশ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে, আর্থিক টানাপোড়েনে রাজনীতি এবং সংস্কৃতি বিমুখ হয়ে পড়েছে।
লকডাউনে সরকার শিল্প-কারখানা খোলা রাখে কিন্তু এসব শিল্প-কারখানার সাথে সংশ্লিষ্ট বা নির্ভরশীল সব ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসা বানিজ্যও বন্ধ থাকে, আদালাত বন্ধ থাকলে আদালত সম্পৃক্ত সমস্ত কর্মকান্ড এবং সংশ্লিষ্ট সবকিছু বন্ধ থাকে,তেমনিভাবে গণপরিবহনের মালিক শ্রমিক সবাই আয়হীন,দেশের লক্ষ লক্ষ নন-এমপিও শিক্ষক,লক্ষ লক্ষ নতুন এনরোল্ড ও শিক্ষানবীশ আইনজীবি,আইনজীবি সহকারী,প্রাইভেট কেজি ও বেসরকারী প্রাইমারী এবতেদায়ী শিক্ষক-কর্মচারী,ফেরত আসা প্রবাসী,বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক শ্রমিক, লকডাউনের কবলে পড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী সবাইতো কোভিডের শিকার।
কোভিড পুর্ববর্তী আয়ের হিসেবে এরা সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তারা হাত পাতেনি কোথাও, হাত দিয়ে রোজগার করেই সংসার চালিয়েছে।আজ তারা দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছে নিরবে, কাউকে তারা এ দুঃখ শেয়ার করতে পারছেনা,অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে, কোথাও হাত পাততে পারছেনা।
দেশে বর্তমানে সরকারী যত প্রনোদনা সব তালিকাভুক্ত দরিদ্র আর উচ্চবিত্তদের অনুকুলেই যাচ্ছে। করোনা কালীন হাজার হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষনা করেও শিল্পপতিদের যেমন তা যথাযথ খাতে ব্যবহার করতে বাধ্য করা যায়নি তেমনি দরিদ্রদেরও কোনমতে সীমার উপরে আনা যায়নি। বরং দরিদ্রের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে।
বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান “ওয়েলথ এক্স” গত বছর জানিয়েছিল, সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশে ধনকুবের অর্থাৎ ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। সুতরাং দরিদ্র ও ধনীক শ্রেণি দুদিক থেকে মধ্যবিত্তের আবাস, অবস্থান ও মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।