বাংলাদেশ ছাত্রলীগঃ ত্যাগের ইতিহাসে সংকটের কালো ছায়া
সংকট সংগ্রামে অবিচল বলা হলেও সাংগঠনিক ব্যর্থতা ও নানা অপকর্মে জর্জরিত ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। অভিযোগ যেন সংগঠনটির পিছু ছাড়ছে না। অতীতে নিজেদের মধ্যে মারামারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকলেও বর্তমান সময়ে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো গর্হিত কাজে নাম চলে আসছে ছাত্রলীগের।
এছাড়াও ছাত্রলীগের তৃনমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তিও হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। সংগঠনটির ১১১টি ইউনিটের বেশীরভাগের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। যে কয়টি ইউনিটে নতুন কমিটি করা হয়েছে সেগুলোরও বেশীরভাগে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয় নাই। এর ফলে নতুন নেতৃত্ব শূণ্যতায় ভুগছে সংগঠনটি। বেশীরভাগ ইউনিটের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে রয়েছে বিবাহিত, টেন্ডারবাজি, মাদক সংশ্লিষ্টতা ও অছাত্র হওয়ার মতো নানাবিধ অভিযোগ।
সম্প্রতি দুই হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম। সিলেট এমসি কলেজে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতরা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ধর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সবুজ আল সাহবা। গত সেপ্টেম্বরে রংপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান সিদ্দিকী রনির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন এক স্কুল শিক্ষিকা।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নথি বের করে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম মুমিনকে। ২০১৬ সালে সিলেটে খাদিজা নামের এক নারীকে কুপিয়ে জখম করে বদরুল নামের স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতা ও তার সংযোগীরা। হামলার একটি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সমালোচনার ঝড় উঠে সচেতন মহলে।
মাঠে শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় ছাত্রলীগ নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের সামনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হয় সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র তাপস সরকার। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে ক্যাম্পাস স্থ নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজ ইরফানের ঝুলন্ত লাশ। শুরুতে এটিকে আত্মহত্যা বলা হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দরপত্র নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছাত্রলীগের একটি অংশের দ্বারা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলে দাবি করা হয়।
২০১৬ সালে বিদায় অনুষ্ঠানের কর্তৃত্ব ধরে রাখা নিয়ে আভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে খুন হন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সদস্য নাসিম আহমেদ সোহেল। আভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১৭ সালে খুন হন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস।
২০১৬ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন খালিদ সাইফুল্লাহ নামের এক কর্মী। ক্ষমতাসীন দলের ১২ বছরের শাসনকালে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন ছাত্রলীগের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী।
২০১৯ সালে বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ নামে এক ছাত্র। সরজমিনে দেখা যায় দেশের সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে ছাত্রলীগ। প্রায়ই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সাধারণ ছাত্রদের উপর চড়াও হয়ে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে সংগঠনটি। এছাড়াও চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি, র্যাগিং, আধিপত্য বিস্তারের ঘটনাও সাধারণ বিষয়। ছাত্রলীগের দাপটে এক প্রকার ভীত সন্ত্রস্ত সাধারণ ছাত্ররা।
নানা অপরাধ ও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়লেও সংগঠনটির হাইকমান্ড থেকে কোন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। কোন ঘটনা ঘটলেই তড়িঘড়ি করে বহিষ্কার ও অনুপ্রবেশকারীদের কাজ বলে এক ধরনের দায় এড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায় সবসময়। কিন্তু পরবর্তীতে সংগঠনের আভ্যন্তরীণ সংকটের কারণ নির্ণয়, উচ্ছৃঙ্খল ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত কর্মীদের চিহ্নিত করণ কিংবা ছাত্রলীগের তৃনমূল পর্যায়ে কাউন্সিলিং এর কোন ব্যবস্থা করা হয় না। ফলশ্রুতিতে বারবার একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
সুশীল সমাজ ও সমাজকর্মীদের মতে, “ক্ষমতা ও অর্থবৃত্তের লোভ সংগঠনটির অধপতনের মূল কারণ। একসময় ছাত্রনেতারা সাদামাটা জীবনযাপন করলেও বর্তমানে সেটি প্রায় বিলুপ্ত। পুঁজিবাদের হাওয়া সংগঠনের গায়েও লেগেছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নীতি আদর্শের চেয়ে ক্ষমতার চর্চা বেশী হচ্ছে। নেতা নির্বাশনে নৈতিক চরিত্র বিবেচনার চেয়ে দূর্বৃত্তায়ন ও মাসল পাওয়ার বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে।” এসবই ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর ধারাবাহিক ব্যর্থতার মূল কারণ মনে করেন বিশিষ্ট জনেরা।
এমসি / বে অব বেঙ্গল নিউজ।