নারায়ণগঞ্জে হত্যার ৫০ দিন পর জীবিত ভিকটিমঃআদালতে জবানবন্দী
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে জিসা মনি। সে স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। গত ৪ঠা জুলাই থেকে সে নিখোঁজ হয়। মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করে কোথাও না পেয়ে এক মাস পর ৬ই আগস্ট বাবা জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন।
মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, এলাকার যুবক আব্দুল্লাহ তার মেয়েকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বিভিন্ন সময় প্রেমের প্রস্তাব দিতো। এতে বাধা দিলে মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেয়। গত ৪ঠা জুলাই সন্ধ্যায় আব্দুল্লাহ ফোনে ঠিকানা দিলে তার মেয়ে সেই ঠিকানায় যায়। পরে তাকে গাড়িতে করে অপহরণ করে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা। এমন সন্দিহানের পর থেকেই তার মেয়ের কোনো সন্ধান পাননি তার পরিবার।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীম জানিয়েছেন, মেয়েটির মায়ের মোবাইলের কললিস্ট চেক করে রকিবের সন্ধান পায় পুলিশ। রকিবের মোবাইল নম্বর দিয়ে আব্দুল্লাহ কিশোরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতো। ঘটনার দিনও ওই নম্বর দিয়ে কল করে আব্দুল্লাহ। এ ঘটনায় ৭ই আগস্ট আব্দুল্লাহ (২২), রকিব (১৯) ও নৌকার মাঝি খলিল (৩৬)কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত,৯ই আগস্ট দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবিরের পৃথক আদালতে গ্রেপ্তারকৃত তিনজনকে জবানবন্দি দেয়ার জন্য হাজির করে পুলিশ। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনজন বলে জিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
কিন্তুু, ২৩শে আগস্ট রোববার দুপুর আড়াইটার সময় বন্দরের নবীগঞ্জ রেললাইন এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে জিসা মনি তার মা রেখা আক্তারকে ফোন করে জানায়, সে বেঁচে আছে, ভালো আছে। তবে কিছু টাকার প্রয়োজন। এমন কথায় টাকা পাঠিয়ে উল্লিখিত এলাকায় দোকানটিতে ছুটে যান জিসার মা-বাবা। এ ছাড়াও এ অবিশ্বাস্য ঘটনায় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুনকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর তার বাবা-মা ছুটে যান বন্দর থানাধীন নবীগঞ্জ এলাকার সেই মোবাইল ফোনের দোকানটিতে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মেয়েকে চোখের সামনে দেখে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। জিসার বাবা জাহাঙ্গীর আলম জানান, পুলিশ বলেছিল আমার মেয়েকে ধর্ষণের পর নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নির্দোষ ৩ জনকে আটক করেছে তারা।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, বন্দরের কুশিয়ারা এলাকায় ইকবাল ওরফে ইব্রাহিম নামে এক ছেলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গত দেড় মাস ধরে এক সঙ্গে বসবাস করেছে জিসা। পুলিশ ইকবালকে আটক করেছে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুন বলেন, ইকবাল ও জিসা একে অপরের পরিচিত ছিল। গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল। রোববার জিসা মনির সন্ধান পাওয়া যায় সে ইকবাল নামে এক যুবকের সঙ্গে ছিল। পুলিশ ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।
যদিও এর আগে মামলার তদন্তকারী অফিসার শামীম আল মামুন অভিযুক্তদের জবানবন্দি প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে জিসার সঙ্গে বখাটে আবদুল্লাহ তার বন্ধু ইজিবাইকচালক রকিবের মোবাইল দিয়ে ৩ মাস প্রেম করেছে। ঘটনার দিন ৪ঠা জুলাই ঘোরাফেরার কথা বলে তাকে ইস্পাহানি ঘাটে ডেকে নেয় আবদুল্লাহ। এরপর বন্দরের বিভিন্ন স্থানে রকিবের ইজিবাইক দিয়ে ঘোরাফেরা করে। পরে রাত ৮টায় ইস্পাহানি ঘাটে এসে খলিলুর রহমানের নৌকায় উঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঘুরতে থাকে। এক পর্যায়ে নৌকার মধ্যেই আবদুল্লাহ প্রথমে জিসাকে ধর্ষণ করে। এরপর মাঝি খলিলুর রহমানও জোর করে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এতে কিশোরী বাকবিতণ্ডা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে খলিলুর রহমান সেই কিশোরীর দুই পা চেপে ধরে আর আবদুল্লাহ গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর দুইজনে মিলে সেই ৫ম শ্রেণির স্কুলছাত্রী কিশোরীকে শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝখানে ফেলে দেয়।
জবানবন্দি রেকর্ডের পর আদালত তিনজনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারান্তরীণ।
কিন্তু ৫০ দিন পর জিসা মনি নিজেই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় হাজির হয়। তোলপাড় শুরু হয় প্রশাসনে। মুহূর্তে তদন্তকারী কর্মকর্তা সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উপর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের মামলা তদন্ত আদালতে দেয়া জবানবন্দি নিয়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সদর মডেল থানায় ছুটে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান। সোমবার দুপুরে তিনি গণমাধ্যমকে ব্রিফিং করেন। পরে ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশ সুপার জাহেদুল আলম তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
এদিকে ৫০ দিন পর মেয়েকে জীবিত পেয়ে খুশিতে আত্মহারা জিসার মা-বাবা। অন্যদিকে কারাবন্দি নিরপরাধ তিন ব্যক্তির স্বজনরা অভিযোগ করেছেন পুলিশ টাকা নেয়ার পর অমানুষিক নির্যাতন করে তাদের হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে।
তারা বলছেন, জিসা মনি হত্যা হয়নি। কিংবা তাকে নির্যাতনও করা হয়নি। সে অন্য এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। অথচ তাকে অপহরণের দায়ে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে পুলিশি নির্যাতনের মুখে তাদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়।
সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ মডেল থানার সামনে জিসা মনিকে অপহরণের মামলায় গ্রেফতার যুবক আব্দুল্লাহ, তার বন্ধু রকিব ও নৌকার মাঝি খলিলের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তারা এই অভিযোগ করেন।
গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহার মা শিউলী আক্তার বলেন, ‘আব্দুল্লাহ ওয়ার্কশপে কাজ করতো। আমার ছেলের একটি স্টেটমেন্ট ছিলো যে, আমি ওর সঙ্গে ঘুরছি একসাথে। আর কিছু করি নাই। বিনা কারণে আমার ছেলেরে এত কিছু সহ্য করা লাগছে। যদি আমার ছেলে কিছু করতো তাহলে মেয়েটা জীবিত ফিরে আসলো কেমনে? আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীমকে দুই দফায় ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমে যখন ধইরা আনে তখন টর্চার যাতে না করে সেজন্য সাত হাজার টাকা দিছি। পরে আরও তিন হাজার টাকা দিছি। টাকা না দিলে তারে মাইরা ফালানোরও হুমকি দিছে। টাকা দেওয়ার পর সে (এসআই শামীম) কইছে আমার ছেলেরে মারবো না।কিন্তু তারে মাইরা মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়াইছে।’ এই বলে কাঁদতে থাকেন তিনি।
নৌকার মাঝি খলিলের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘সন্দেহ কইরা আমার স্বামীরে ধইরা আনছে। পরে পুলিশ বলছে, ওই মেয়েরে নাকি আমার স্বামী মাইরা ফেলছে। এখন তো দেখতাছি এই মাইয়া বাঁইচা আছে। আমার স্বামীরে কেন পুলিশ ফাঁসাইলো সেইটা আমি জানতে চাই।
’শারমিন আরো বলেন, ‘আমার স্বামী নির্দোষ, তারে ছাইড়া দেন। এই কথা বারবার পুলিশরে বলছি। তখন আমারে কইলো, বেশি কথা বইলো না। বেশি কথা বললে সবাইরে জেলে ঢুকাইয়া দিমু।’একই অভিযোগ আরেক আসামি রকিবের ভাই সজিবেরও। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ওইদিন ঘাটে মেয়েরে নামাইয়া দিয়া আসছে বলে জানাইছে। এরপর কিছু জানে না। কিন্তু পুলিশ তারে মার্ডার মামলার আসামি বানাইয়া দিল। তার জেল খাটতে হইতাছে। এর বিচার আমি চাই।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত ৪ জুলাই বিকালে জিসা মনি হারিয়ে গেছে মর্মে থানায় তার বাবা একটি জিডি করেন। জিডি নং ৫৩২। জিডির প্রেক্ষিতে কল লিস্ট থেকে আব্দুল্লাহ নামে একজনের নাম জানতে পারি। পরে জিসার বাবা এ মামলা করে ৭/৩০ ধারায়। মামলা নং ৬/৮/২০২০। যেখানে আব্দুল্লাহকে প্রধান আসামি, রকিকে দুই নম্বর আসামি করা হয়। আমরা আসামিদের গ্রেফতার করি। তারা বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দি দেন যে, তারা একটি মেয়েকে নৌকাতে করে ঘুরিয়ে ধর্ষণ করে। পরে তাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।
রিমান্ডের নামে এসআই শামীমের টাকা নেওয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, এ ধরনের তথ্য যদি থাকে, এটা আমাদের নলেজে এসেছে এবং বিশেষ করে এই বিষয়েই এখানে আমাদের আসা হয়েছে। আমাদের পুলিশ সুপার বিষয়টা দেখছেন। যদি আমাদের কোন পুলিশ সদস্য এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
পুলিশের খাতায় মৃতের তালিকায় থাকা স্কুল ছাত্রী দিসা মনি জীবিত ফিরে আসার পর আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আফতাবুজ্জামানের আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
জিসা মনি আদালতের তার নিখোঁজ থাকার বিষয়, প্রেম, বিয়ে এবং ফিরে আসার পুরো ঘটনা বর্ণনা করে। পরে বয়স বিবেচনায় আদালত তাকে পরিবারের জিম্মায় দেয়ার আদেশ দেন।এদিকে পুলিশ দিসা মনি স্বামী ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠিয়েছে। মঙ্গলবার তার রিমান্ড শুনানি হবে।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে স্কুল ছাত্রী দিসা মনির মেডিকেল টেস্ট করা হয়েছে। এরপর বিকেলে আদালতে ২২ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তার পরিবারের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়েছে।তিনি আরো বলেন, দিসা মনির স্বামী ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।এদিকে দিসা মনির বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসছি। মেয়েকে যেহেতু পেয়ে গেছি তাই আমার আর কোন অভিযোগ নাই।
এসি/বিবিএন/স্টাফ রিপোর্টার